রাজধানীর মাটিকাটায় ১৫ বছর ধরে চলছে আইডিয়াল পাবলিক স্কুল। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীসংখ্যা ৩০০। শিক্ষক-কর্মচারী ২৫ জন। স্কুলটি বিক্রি করে দিতে নোটিশ টাঙানো হয়েছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক নারগীস আক্তার আফসোস করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানটির পেছনে আমার খরচ সোয়া এক লাখ টাকা। মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়িভাড়া ও শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করেছি। এরপর আর দিতে পারছি না। বাড়িওয়ালা বলে দিয়েছেন, এক মাসের ভাড়া মওকুফ করবেন। তার পরও তো অনেক টাকা দরকার। কোথায় পাব? দেনা না বাড়িয়ে তাই স্কুলটি বিক্রি করে দেওয়ার নোটিশ দিয়েছি। ন্যূনতম দাম পেলেই বিক্রি করে দেব।’
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সমস্যা না হলেও ঘোর বিপদে পড়েছেন ১০ লাখ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী। বেতনের সঙ্গে প্রাইভেট টিউশনিও বন্ধ। ফলে সংকট আরো বেড়েছে। উপায় না পেয়ে উদ্যোক্তারা স্কুল বিক্রি করে দিতে চাচ্ছেন। অনেক কিন্ডারগার্টেন স্কুলও বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। রাস্তার মোড়ে, স্কুলের সামনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব স্কুল বিক্রির নোটিশ ঝুলছে।
দেশে প্রায় ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ছয় লাখ শিক্ষক কর্মরত। টিউশন ফির টাকায় বাড়িভাড়া, বিভিন্ন বিল, শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের সন্তানরা লেখাপড়া করে। বর্তমানে তারা বেতন দিতে পারছে না। আবার নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে সাড়ে সাত হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। এ ছাড়া এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রয়েছেন কয়েক লাখ অস্থায়ী ও খণ্ডকালীন শিক্ষক। এই শিক্ষকদের বেশির ভাগ বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবন থেকে রক্ষায় অন্য পেশায় যাচ্ছে।
সাভারের বাইপাইলের সৃজন সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজটিও বিক্রির নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শামীম ইকবাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতি মাসে আমার খরচ ৮০ হাজার টাকা। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টিউশন ফি পেয়েছি। মার্চ পর্যন্ত বাড়িভাড়া ও শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করেছি। এখন আর উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। ফলে স্কুল বিক্রির নোটিশ টাঙিয়েছি।’
রাজধানীর মাটিকাটার ব্লু বার্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক মিলন হোসেন বর্তমানে ভ্যানে করে পেঁয়াজ, রসুন বিক্রি করছেন। ম্লান মুখে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির পর আর বেতন পাইনি। প্রাইভেট-টিউশনিও বন্ধ। চার সদস্যের পরিবার নিয়ে কিভাবে চলব? বাধ্য হয়ে তাই ফেরি করছি। আমি শিক্ষক। সরকারের কাছে আকুল আবেদন, আমাদের শিক্ষকতা পেশায় ফেরার সুযোগ দিন।’
রাজধানীর একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ১০ বছর ধরে শিক্ষকতা করেন নাছিমা খানম। কাতর কণ্ঠে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার স্বামী মারা গেছেন বেশ আগে। এক সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, আরেকজন স্কুলে। ফেব্রুয়ারির পর আর বেতন পাইনি। খেয়ে না খেয়ে বহু কষ্টে বেঁচে আছি। এলাকায় সবাই শিক্ষক হিসেবে সম্মান করেন। কারো কাছে তো হাত পাততে পারছি না! আবার সংসারও চালাতে পারছি না। এ এক বিপন্ন পরিস্থিতি!’
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের ৪ নম্বর সড়কের ফুলকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন স্কুলটিও বিক্রির নোটিশ দেওয়া হয়েছে। স্কুলটির পরিচালক তকবির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে অভিভাবকরা টিউশন ফি দিতে পারছেন না। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়িভাড়া ও শিক্ষকদের বেতন দিয়েছি। দিন দিন বাড়িভাড়া বকেয়া পড়ছে। বাধ্য হয়ে তাই স্কুলটি বিক্রির নোটিশ দিয়েছি।’
বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের মহাসচিব সাফায়েত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চার মাস ধরে বাড়িভাড়া ও শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করতে না পারায় ব্যক্তিমালিকানাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ৭০ শতাংশ শিগগিরই বন্ধ হয়ে যাবে। এ খাতকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্থিক সহায়তা কামনা করছি।’
খুলনার পাইকগাছার ডেলুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীসংখ্যা ২০০। শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন ১২ জন। স্কুলটির প্রধান শিক্ষক সুব্রত কুমার। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘স্কুলটি দুর্গম এলাকায়। তার পরও গত বছর আমরা এমপিওভুক্ত হতে পারিনি। শিক্ষকদের বেতন দিতে না পারায় বেশির ভাগ শিক্ষক পেশা পরিবর্তন করছেন। সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক আশীষ কুমার, ধর্মীয় শিক্ষক রবিউল আওয়াল রাতে মাছ ধরে দিনে বিক্রি করছেন। আমি নিজেও মাছ বিক্রি করছি। ২০ বছর ধরে শিক্ষকতা পেশায় আছি। অন্য কাজে মন সায় দেয় না।’